স্বাধীনতা সংগ্রামে মাগুরার দলিত জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও নেই যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি

যিনি মুক্তিযুদ্ধ কালীন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন।
মোছাঃ সালমা খাতুন, মাগুরা :
একাত্তরে এ দেশের ওপর দিয়ে প্রচন্ড এক ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মার্চ থেকে ডিসেম্বর এ কয়টি মাস বারুদের গন্ধে বাতাস হয়েছিল ভারী। চারদিকে অগণিত লাশ, আর্তনাদ আর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা। বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি নিয়ে এক কোটি মানুষ চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নিয়েছিল। এর মধ্যেই চলেছিল দলিত নিষ্পেষিত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রাম, সশস্ত্র লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাস পর অনেক আতœত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের এই দেশ চোখ মেলে তাকিয়েছিল, জেগে উঠেছিল ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের অবদান কোন অংশে কম নয়। এ বিষয়ে সরেজমিনে কথা হয় মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার নালিয়া গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের ধীরেন দাসের সাথে। মুক্তিযুদ্ধাদের তিনি খাবার সরবরাহ করেছেন বলে জানালেন। তবে তিনি আক্ষেপ করে বললেন যে, আমাদের প্রতি সমাজের শোষণ ও বঞ্চণার শেষ কোথায় জানি না। তিনি জানালেন মাগুরায় স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী দলিত কলু সম্প্রদায়ের শ্রী সুরেনের কথা।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে মাগুরায় সর্বপ্রথম জীবন উৎসর্গকারী ছিলেন কুলু সম্প্রদায়ের। দলিত জনগোষ্ঠীর কুলু সম্প্রদায়ের শ্রী সুরেন সর্বপ্রথম মাগুরার স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন দান করেন।
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল শুক্রবার দুপুরের দিকে ঝিনাইদহ থেকে আলমখালী হয়ে এবং যশোর থেকে সীমাখালীর পথ ধরে পাক সেনারা একযোগে মাগুরার দিকে আসতে থাকে। ঝিনাইদহ থেকে আগত পাকসেনা দলের বিশাল গাড়ীর বহর মাগুরার আলমখালী বাজার সংলগ্ন রাস্তায় থামিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে থাকে। এসময় আলমখালী ব্রীজ ও রাস্তা সংলগ্ন উত্তরের বাড়ীর বাসিন্দা কুলু স¤প্রদায়ের শ্রী সুরেন কুলু ভয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পাক সেনারা তার আঙ্গিনায় সুরেন কুলুকে গুলি করে হত্যা করে।
ধীরেন দাস আরও বললেন যে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্য ঘুচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও সমাজের দলিত শ্রেণী নানা রকমের বৈষম্যের শিকার। সমাজের প্রান্তিক দলিত জনগোষ্ঠী চেয়েছিল বৈষম্য থাকবে না, বেঁচে থাকার ন্যূনতম পণ্যগুলো সহজলভ্য হবে। মানুষ খেয়েপরে সম্মানের সাথে সুখে-শান্তিতে থাকবে।
কিন্তু দলিত জনগোষ্ঠীদের বেলায় স্বাধীনতার এত বছর পর খাতা খুলে হিসাব মেলানো এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে দলিত সম্প্রদায়ের এত অবদান থাকার পরও তাদের অবহেলার জীবনের অবসান ঘটে নাই।
স্বাধীনতা নিছক শ্লোগান ছিল না। এ ছিল বাঁচার অবলম্বন। সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াবে, একসঙ্গে বাঁচবে, সমাজে ভেদাভেদ থাকবেনা, দলিতরা সম্মানের সাথে বৈষম্যহীন সমাজে বসবাস করবে এবং এটাই হবে স্বাধীনতার চেতনার সত্যিকার বাস্তবায়ন।
বৃটিশ আমলে বৃটিশরা যেমন সমাজের অবহেলিত দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর শোষণ ও নির্যাতন চালাতো ঠিক তেমনি পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বিশেষ করে দলিত জনগোষ্ঠীকে চরম বৈষম্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত করেছিল। এই নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই অনেক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যতা থেকে মুক্তি পেয়েছে কিনা তা আজ স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রশ্নবিদ্ধ। দলিত জনগোষ্ঠীকে পিছনে রেখে কখনও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কল্পনা করা যাবে না। তাই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের যথাযথ মর্যাদা যদি দিতে হয় তবে দলিত সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলে সংখ্যালঘু দলিত সমাজের শোষণ বঞ্চনার দিন শেষ হবে। সমাজের একটি শ্রেণীকে অবহেলায় রেখে কখনও সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে দলিত জনগোষ্ঠীর সুরেনের মত অনেক সুরেনের অবদান রয়েছে। যদিও তাদের সেই ঋণ শোধ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার, তারপরও তাদের সেই আত্মœত্যাগকে স্বার্থক করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সমাজের দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে পাশে দাঁড়ানো আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
মোছাঃ সালমা খাতুন, তৃণমূল সংবাদকর্মী এবং বাংলাদেশ দলিত হিউম্যান রাইটস্ মিডিয়া ডিফেন্ডার ফোরামের সদস্য।