ভোলায় দলিত পল্লীর এক ঘরেই চার পরিবারের বাস
অচিন্ত্য মজুমদার :: ভোলা শহরের থেকে রিকশায় ডোমপট্টি থামতেই হরিজন পল্লীর অবস্থান। ঢুকতেই মনে হবে দেশের প্রচলিত কোনো এলাকা থেকে ভিন্ন এলাকায় ঢুকছি। আধো আলো, আধো অন্ধকার, জলে ভেজা-স্যাঁতসেঁতে ছোট ছোট খুপরি ঘর, উন্মুক্ত ড্রেন থেকে ভেসে আসছে ময়লা-দুর্গন্ধ। তার মধ্যেই হরিজন পল্লী। এমনই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে এখানকার মানুষ। এরা পেশায় কেউ সুইপার, কেউ ঝাড়ুদার, হাতল গাড়ি চালক, আবার কেউ ড্রেন ম্যান। পৌরসভা ও হাসপাতালে এরা চাকরি করে। এদের বেতন শুনলে অবাক হতে হয়। দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষ জানান, আমরাওতো ভোট দেই। আমাদের ভোটে প্রার্থী নির্বাচিত হয়। কিন্তু আমাদের খোঁজ রাখে না কেউ।
হরিজন পল্লীর বাসিন্দা দিলীপ লাল হেলা, দুলাল ডোম, বরুন লাল ডোম ও মিঠুন লাল হেলা জানান, আমাদের এই হরিজন পল্লীতে ৪০টি খুপরি ঘর। তাতে ১২০ পরিবারের ৩৫০ লোক বসবাস করে। বিবাহিত ছেলেমেয়ে, বাবা-মা সবাই এক ঘরেই থাকতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায় ওই একটা খুপরি ঘরে ৩/৪টা পরিবার অমানবিকভাবে বসত করছে। যাবে কোথায়? এ চাকরিটাও রাখতে হয়। নইলে থাকবে কোথায়? হরিজন পল্লীর মাতবর মানিক লাল ডোম এক নিঃশ্বাসে এ কথাগুলো বলেন।
বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন ভোলা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার দে জানান, ওই পল্লীর ছোট ছোট ঘরের মধ্যে আলো, বাতাস কিছু যায় না। স্বাধীনতার পরে তৈরি হওয়া এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গত ৪৫ বছরে কোন সংস্কার না হওয়ায় কলোনির প্রতিটি ঘর ঝুকিপূর্ণ হয়ে গেছে। ঝড়-তুফানে নড়-বড় করে। ঘরের চালা ভাঙা থাকায় একটু বর্ষা হলেই পানি পড়ে ঘর ভিজে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এরপর আবার খোলা ড্রেন কলোনির পাশ দিয়ে চলে গেছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। বর্ষাকালে অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিস যেন এখানে বাসা বেঁধেছে। এছাড়া ভোলার জেলার বাকি ৬ উপজেলায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি ভাবে আবাসন ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনোমতে জরাজীর্ণ খুপরিতে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ভোলা পৌর ৫নং ওয়ার্ডের চরনোয়াবাদ এলাকায় একটি ঝুপড়িতে থাকা দলিত জনগোষ্ঠীর সদস্য ললিত রবিদাস জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে জুতা সেলাই করে তার ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে এই ঝুপড়িতে বসবাস করছে। জীবনের মান উন্নয়নে সরকারের তরফ থেকে জন্মলগ্ন থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। সরকারি ভাবে জমির কোনো মালিকানা পেয়েছেন কিনা বা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ জমির মালিকানার ব্যাপারে আমদের কেউ কোন পরামর্শ দেন নি। তাই আমরা জানিও না দলিতদের জন্য সরকার জমির মালিকানা দেয় কি না।” একই কথা জানালেন পৌর বাপ্তা এলাকার হরিজন কলোনির বাসিন্দা স্বপন ডোম ও মো: ফারুক। তারা হরিজন কলোনীতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। তাদের কাছে নিজেদের একখন্ড জমি স্বপ্ন ছাড়া কিছুইনা। তবে কখনো কোথাও এব্যাপারে আবেদন করেনিন তারা। সরকার তাদের জমির মালিকানা দিলে তারা আর নিজেদের সমাজের বোঝা ভাবতেন না।
বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মানিক লাল ডোম জানান, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করে সকল মানুষকে সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা থাকলেও এ দেশের দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জনগণ এখনো প্রতিনিয়ত নাগরিক, রাজনৈতিক, সামজিক, সাস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য খাসজমি বরাদ্দ দিতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিলেও স্থানীয় সরকার পর্যায় থেকে দলিতদের নানা কৌশলে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ভোলা পৌর সভার নির্বাহী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন আরজু জানান, দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের নির্ধারিত স্থানে পৌর সভার পক্ষ থেকে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী বছর নাগাদ এ প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এছারা তাদের কলোনি বসবাসের উপযোগী রাখতে পৌর সভার পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে সেখানে ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ে টয়েলেট সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে।