আয়শা খানমের প্রয়াণে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী এবং সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানমের প্রয়াণে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আয়শা খানমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৭ জানুয়ারি ২০২১ (রবিবার) বিকাল ৩:০০ টায় অনলাইনে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।
সভায় স্মৃতিচারণ করেন চ্যানেল আইয়ের বিশেষ সংবাদদাতা জান্নাতুল বাকিয়া কেকা; সংগঠনের পাঠচক্রের সদস্য হালিমা তুস সাদিয়া;; দৈনিক ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার সেবিকা দেবনাথ; মেন এন্ড বয়েজ এনগেজমেন্টের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হাবিবুর রহমান; হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশন্যালের প্রকল্প কর্মকর্তা নাজমা আরা বেগম পপি, দৈনিক যুগান্তরের সুরঞ্জনা পাতার বিভাগীয় সম্পাদক রীতা ভৌমিক; চলচ্চিত্র নির্মাতা জান্নাতুল ফেরদৌস আইভি; ডিবিসি নিউজের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ইশরাত জাহান উর্মি; অবস এন্ড গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি সামিনা চৌধুরী; নারীপক্ষের সদস্যএ্যাড. কামরুন নাহার; সেভ দ্য চিলড্রেনের জেন্ডার অ্যাডভাইজার উম্মে সালমা বেগম; মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো- অর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের ডেপুটি ডিরেক্টর শাহানাজ সুমী; আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক; ব্লাস্টের অ্যাডভোকেসি ও কমিউনিকেশন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মাহবুবা আক্তার; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, আয়শা খানমের জীবনের যে জীবনের বহমানতা দেখি তাতে দেখি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সমাজের সর্বত্র সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। তিনি নারীর মানাবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী আন্দোলন, অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রগতিশীলতার আন্দোলনে গোটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তিনি বলতেন ‘‘নারী আন্দোলন একটি নকশিকাথা, আমি একা পারব না, তুমিও একা পারবে না, এখানে সবাইকে কিছু না কিছু বুনে যেতে হবে।’’ তার একটা গুণ ছিলো বক্তব্য দেয়া এটা চুম্বকের মত মানুষকে টানত। নারী আন্দোলনকে সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি দূরদর্শিতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারী আন্দোলনে সকল শ্রেণীর নারী ও পুরূষকে তিনি যুক্ত করার প্রয়াস করেছন। ৯০ এর পর যখন নারী আন্দোলনের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হয় তার সাথে সংগঠনকে যুক্ত কওে সময়উপযোগীকর্মপরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়াস নেন। তাঁর রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পূর্ণ করতে তা প্রবাহ রাখার আহবান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
সভায় বক্তারা আয়শা খানমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন বছরের শুরুর দিকে আপার চলে যাওয়া আমাদের সকলকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় । তিনি ছিলেন অনেক বড় মাপের একজন নারী নেত্রী। তার যোগাযোগ তৃণমূল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন আয়শা খানম। তার জন্ম নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে। সেখান থেকে নিজ যোগ্যতার তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজের মানবিক বোধগুলো উন্নত করার সাথে সাথে ছাত্ররাজনীেিত যুক্ত হওয়া এর পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, আগরতলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নানভাবে সাহায্য করেন। তিনি অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। তার যোগাযোগ ছিলো তৃণমূল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত। ১৯৭২ থেকে মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত হয়ে এদেশের নারীদের সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে আসতে, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারী আন্দোলনের কাজে নিরলসভাবে দুরদর্শিতার সাথে কাজ করতে থাকেন । তিনি সকলকে একত্রিত করে তিনি নারী আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে তিনি সবসময় অগ্রণী ভ’মিকা পালন করেছেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য, অভিন্ন পারিবারিক আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য , ধর্ষণের বিচারের ঘটনায় টু-ফিঙ্গার টেষ্ট নিষিদ্ধের দাবিতে এবং জেন্ডার বাজেট বিশ্লেষণের কাজ তিনি জোরালোভাবে করেছেন। দাবি আদায়ে তার কণ্ঠ সবসময় দৃঢ় ও সোচ্চার থেকেছে। সরকার বা ডোনার এজেন্সির কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। তিনি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সাহস দিয়েছেন সবসময়।পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর নারীদেও জন্য এবং বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন নারীদের বিষয়গুলো তিনি আলাদাভাবে গুরুত্বসহকারে দেখতেন, তাদেও কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। পাশাপাশি বক্তারা আরো বলেন নারী ইস্যুগুলো মিডিয়াতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি সবসময় আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। সিডও নিয়ে আন্দোলন তৈরির পেছনেও রয়েছে তার বিরাট অবদান। কেবল তাই নয় পাঠচক্রের সদস্যদেও তিনি পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স দিয়ে সাহায্য করতেন। নারী আন্দোলনের জন্য তিনি একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সেটিকে প্রাকটিক্যালি কাজে লাগানোর জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। সবশেষে বক্তারা আয়শা খানমের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আগামী ৮ই মার্চে আন্তর্জাতিক নারী আয়শা খানমের স্মৃতিকে স্মরণে রেখে কি কর্মপরিকল্পনা নেয়া যায় সেটি ভাবতে, ইয়ুথ গ্রæপের সামনে তার কর্মবর্ণিলময় জীবন তুলে ধরার জন্য, নারী আন্দোলনে তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে এবং আয়শা খানমের রেখে যাওয়া শেষ বইয়ের কাজ সমাপ্ত করার জন্য, ডকুমেন্টরি তৈরি করতে এবং স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের জন্য মহিলা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। তারা আরো বলেন নারীদের অগ্রযাত্রায় মহিলা পরিষদেও ভ’মিকা যেমন শেষ করা যাবে না তেমন আয়শা খানমের অবদানের কথাও ভুলতে পারবনা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে চারজনকে হারিয়েছি। অত্যন্ত বেদনার ভার নিয়ে আমরা পথ চলেছি। ৬০ এর দশকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তিনি তখন ছাত্ররা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছিলেন। পাঠ্যসূচীর বাইরেও পড়াশোনা হত। কোন বই পড়ার পড়ে তার জ্ঞান জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে থাকতেন। ঐসময় নারী আন্দোলন গড়ে তোলা সহজ ছিলো না। নারী নির্যাতন মানবাধিকার লংঘন এই ধারণা ৭০ এর দশকে ছিলো না। ৭০-৮০ দশক পর্যন্ত নারী আন্দোলনের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব পায়, এর পেছনে আয়শা খানমের অবদান আছে। পাশ্চাত্যের নারী আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলনের সাথে সংগঠককে যুক্ত করতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে কাজ করেছেন তিনি। নারী আন্দোলনে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার মূল কাজটা করেন তিনি। সকলের সাথে কাজ করা, কৌশলী হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও দূরদর্শী ছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষহীন থেকে তিনি সবসময় কাজ করেছেন। একজন আয়শা খানম হয়ত তৈরি হবে না তবে নারী আন্দোলনের কাজ চলতে থাকবে তার দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুসরণ করে। নারী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি মানবিক সমাজ গড়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
সভার শুরুতে প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং আজকে প্রয়াত শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক বুলা ওসমানের মৃত্যুতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আজিজুর রহমান তুহিন।
স্মরণসভায় আয়শা খানমের পূর্ণ জীবন-বৃত্তান্ত উপস্থাপন করেন সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটির সংগঠন সম্পাদক কানিজ ফাতেমা টগর। তিনি বলেন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবাধিকার ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় সংগঠক ছিলেন আয়শা খানম। ১৯৭০ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি মহিলা পরিষদের সাথে যুক্ত হন এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০৮ সাল থেকে তিনি সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, আইন সংস্কার আন্দোলন, সিডও বাস্তবায়নসহ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখেন তিনি। ২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েট-এর নেতৃত্ব প্রদান করে আসছিলেন। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
সভা সঞ্চালনা করেন সংগঠনের আইনজীবি দিপ্তী রানী সিকদার।
খবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির।